ক্রায়োনিক্স বা মৃতদেহকে জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা।




সায়েন্স ফিকশন বা হরর মুভি, যেখানে আমরা প্রায়ই দেখি কোনো পাগলাটে বিজ্ঞানীর ল্যাবরেটরি থেকে কিংবা কোনো স্পেসশিপের ঢাকনা খুলে বরফাচ্ছাদিত শীতল কক্ষ থেকে এক দল মানুষ বা এ্যলিয়েন বের হয়ে আসছে যারা কিনা মৃতের মত ঘুমিয়ে ছিল শত শত বছর। আট-দশটা সাধারণ মানুষের মত তাদের চলা-ফেরা, বিশেষ কোনো মিশন নিয়ে শত বছর পরের পৃথিবীতে জেগে উঠেছে তারা। আমরা এসব দেখে শিহরিত রোমাঞ্চিত হই। কিন্তু পাঠক কখনো কি ভেবে দেখেছেন বাস্তবে এটি সম্ভব কিনা? সম্ভব হবে আপনার আমার প্রিয়জনকে এভাবে মৃত্যুঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা? সবাই একবাক্যে না বললেও বিজ্ঞান আমাদের কথা মানতে নারাজ। আজকের বিজ্ঞানের দ্বারা সম্ভব না হলেও অনেক বিজ্ঞানীই কিন্তু মনে করেন একশো বছর, দুইশ বছর কিংবা তিনশো বছর পরের বিজ্ঞান হয়ত পারবে মৃতদেহকে জীবনে ফিরিয়ে আনতে আর এভাবেই ক্রায়োনিক্স প্রযুক্তির উদ্ভব।

ক্রায়োনিক্সকে সরাসরি প্রযুক্তি বললে ভুল হবে এটি হচ্ছে মূলত বিজ্ঞান এবং বিশ্বাসের মিশেল। আমরা যেভাবে খাদ্য ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণ করি ঠিক সেভাবেই এক বিশেষ উপায়ে রাসায়নিক প্রয়োগে মৃতদেহকে রাখা হয় অত্যন্ত শীতল অবস্থায় যাতে করে মানুষের দেহের কোষগুলো নষ্ট না হয়। কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গর যেন বিন্দু মাত্র ক্ষতি না হয়, ঠিক যেন একজন সাধারণ মানুষ ঘুমিয়ে আছে। তবে এটি সাধারণভাবে বরফ দিয়ে ঠাণ্ডা করার মত নয় কারণ এভাবে দেহের কোষগুলো ঠাণ্ডায় জমে ফেটে যেতে পারে আর তাই ক্রায়োনিক্স বিশারদরা এতে প্রয়োগ করে ক্রায়োপ্রোটেকটেনট নামক এক বিশেষ রাসায়নিক, যা দিয়ে মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মৃতদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে শুরু করে রক্তনালির ভেতরের উপাদানকেও সংরক্ষণ করা সম্ভব। এমনকি বিজ্ঞানীরা এও দাবী করেন এতে নাকি মস্তিষ্কের প্রতিটি স্মৃতি পর্যন্ত অক্ষত থাকে। এভাবেই ভবিষ্যতে জাগিয়ে তোলার আশা নিয়ে সংরক্ষণ করা হয় মৃতদেহ আর এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ক্রায়োনিক্স।

ক্রায়োনিক্সের শুরুটা কারো একার হাত ধরে হয়নি। বিভিন্ন সময়ে মৃত্যু নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্কের জের ধরেই এর আবির্ভাব। শুধু মাত্র হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলেই মানুষ মারা যাবে কেউ কেউ এটা মেনে নিতে চাননি। কেননা ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা আছে, অনেকক্ষেত্রে হৃদযন্ত্র কিছুক্ষণ বন্ধ থাকার পরেও মানুষ বেঁচে ফিরে এসেছে। এই ক্ষেত্রে ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের সান্ডারল্যান্ডের বাসিন্দা ২৮ বছর বয়সী দুই মেয়ের বাবা ডেভিড বিঙ্কসের কথা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এপ্রিল মাসের এক সকালে ডেভিডের গোঙানিতে পত্নী লিনেটের ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাশেই স্বামীকে দম নেয়ার জন্য হাঁসফাঁস করতে দেখে বুঝতে দেরি হয়নি যে তার স্বামীর হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। তিনি তৎক্ষণাৎ এমবুলেন্স ফোন করেন। সাহায্যের জন্য অপেক্ষা না করে তিনি মুখে মুখ লাগিয়ে এবং বুকে চাপ দিয়ে স্বামীর শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখার চেষ্টা করেন। মাত্র ৩ মিনিটের মাথায় এমবুলেন্স পৌঁছে যায়। হাসপাতালে ডাক্তারদের অবিরত চেষ্টা এবং ১৬ বার শক দেয়ার পর প্রায় ৭০ মিনিট পরে ডেভিডের হৃদযন্ত্র পুনঃরায় সচল হয়। এই ৭০ মিনিট তিনি কিন্তু অফিসিয়ালি মৃতই ছিলেন, তার কোনো পালস ছিল না। এরপর ডেভিড এক সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এবং কিছুটা সুস্থ হয়ে পরিবারের কাছে ফিরে যান। ডেভিড বলেন, আগেরদিন তিনি আর দশটা সাধারণ মানুষের মতই ঘুমাতে যান কিন্তু পরের দিন যখন জ্ঞান ফিরে আসে নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালের বিছানায়, এর মাঝে কি হয়েছে তার কিছুই মনে নেই। এমন আরও অনেক ঘটনার কথা জানা যায় হৃদযন্ত্র বন্ধ থেকে পুনঃরায় চালু হওয়ার। তাই সত্যিকার অর্থে ঠিক কখন মৃত্যু ঘটে তাই নিয়ে রয়ে গেছে বিতর্ক। আর এই ফাঁকেই উঠে এসেছে ক্রায়োনিক্স। ক্রায়োনিক্স বিজ্ঞানীদের দাবী এর মাধ্যমে নাকি আসল মৃত্যুর কয়েকমিনিট আগেই দেহের সবকিছু আটকে দেয়া সম্ভব এমনকি মৃত্যুকেও (!)

পাঠক আপনাদের কাছে যত উদ্ভটই হোক না কেন। এই ধারণা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপের অনেক দেশেই গড়ে উঠেছে ক্রায়োনিক্স ইন্সটিটিউট। আর এদের সদস্যসংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। অনেক বিত্তবান, তারকা, বিজ্ঞানীরা হচ্ছে এর সদস্য যারা নিজেদের দেহকে এভাবে ঠাণ্ডা মমি করার জন্য দিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতে মৃত্যু থেকে জেগে উঠার আশায়। যেভাবে প্রাচীন মিশরে মমি করা হত পুনঃজন্মের আশায়। একুশ শতকে এসে শুধু এর ধরণ বদলেছে। তবে এই ক্রায়োনিক্স সাধারণ মানুষের জন্য নয়, সদস্যকে অত্যন্ত ধনী হতে হবে এর জন্য। সম্পূর্ণ শরীর সংরক্ষণের প্রাথমিক খরচ ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ ডলার পর্যন্ত। প্রতি বছর গুনতে হবে আলাদা করে বার্ষিক সংরক্ষণ ফি। এর জন্য মৃত্যুর পূর্বে ব্যাংকে রেখে যেতে হবে বিশাল অংকের টাকা।

ক্রায়োনিক্স নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন মুভি, টিভি সিরিয়াল এবং উপন্যাস। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আর্থার সি ক্লার্কের ‘৩০০১: দা ফাইনাল অডিসি’, জ্যাক লন্ডনের ‘অ্যা থাউজেন্ড ডেথস’, এইচপি লাভারক্রাফটের ‘কুল এয়ার’, এডগার রাইস ব্যরোজের ‘দা রিসারেকসন অব জিম্বার জ’। এছাড়া উল্লেখযোগ্য মুভি হচ্ছে পরিচালক ডব্লিউ ডি রিখটারের ‘লেট ফর ডিনার’, ফরেভার ইয়ং। আরও আছে উল্লেখযোগ্য টিভি সিরিজ ‘কোল্ড ল্যাজারুশ’, ‘ড. হু’, ‘গোথাম’ যেখানে দেখানো হয়েছে ক্রায়োনিক্স।

শুনতে যত উদ্ভটই হোক, এতসব ঝক্কি-ঝামেলা, খরচের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে যদি কোনোভাবে আরেকটিবার এই পৃথিবীতে ফিরে আশা যায়। পৃথিবীর খোলা হাওয়াতে আরেকটিবার শ্বাস নেয়ার জন্য বিত্তবানরা সব দিয়ে দিচ্ছে আর বিজ্ঞানীরা প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। আসলেই কি সম্ভব হবে আবার কোনদিন ফিরে আশা ???

কোন মন্তব্য নেই

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷

Blogger দ্বারা পরিচালিত.