যত্রতত্র মোবাইল টাওয়ারে বাড়ছে ক্যান্সারের ঝুঁকি
রাজধানীর নামকরা হাসপাতাল বারডেম। এই হাসপাতালের উপর চারটি মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার। কোনো ঝুঁকি বিবেচনা না করেই মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোকে টাওয়ার স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছেন ভবন মালিকরা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব টাওয়ারের রেডিয়েশন স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে ব্রেন টিউমার ও ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সিটি করপোরেশন বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে এসব টাওয়ার বসানোর জন্য নেওয়া হচ্ছে না
কোনো ধরনের অনুমতি। শুধু ভবন মালিকের সঙ্গে চুক্তি করেই টাওয়ারগুলো বসানো হচ্ছে। টাওয়ারের কারণে সংশ্লিষ্ট ভবনটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
কোনো ধরনের অনুমতি। শুধু ভবন মালিকের সঙ্গে চুক্তি করেই টাওয়ারগুলো বসানো হচ্ছে। টাওয়ারের কারণে সংশ্লিষ্ট ভবনটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
রেডিওলজিস্ট ও ক্যান্সার হাসপাতালের ক্যান্সার এপিডিমিয়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন ইত্তেফাককে বলেন, যে কোনো ধরনের রেডিয়েশনই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এটি দৃশ্যমান নয়। আজকে যে রেডিয়েশনের শিকার হচ্ছে, কয়েক বছর পর এর প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। তিনি বলেন, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রেডিয়েশনের কারণে ব্রেন টিউমার হচ্ছে। যেটা অবশ্যই আশঙ্কার। বাংলাদেশে বিভিন্ন ভবনের ছাদে ৬টি মোবাইল ফোন অপারেটরের এ ধরনের ৪০ হাজার ৭০০টি টাওয়ার রয়েছে। এসব টাওয়ার থেকে কি পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই। এসব টাওয়ারের মধ্যে গ্রামীণফোনের ১২ হাজার, বাংলালিংকের ৯ হাজার, রবির সাড়ে ৮ হাজার, এয়ারটেলের ৬ হাজার, টেলিটকের ৩ হাজার ৭০০ এবং সিটিসেলের দেড় হাজার। টাওয়ারগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন ভবনের ছাদে বসানো।
জানা গেছে, টাওয়ার ব্যবস্থাপনার একটি নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। এই নীতিমালা বিটিআরসি থেকে মন্ত্রণালয়, আর মন্ত্রণালয় থেকে বিটিআরসির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ তা আলোর মুখ দেখছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গাইডলাইনটা চূড়ান্ত হয়ে গেলে টাওয়ার ব্যবস্থাপনা তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে দেওয়া যেত। তখন অনেক অযাচিত টাওয়ার খুলে ফেলাও সম্ভব হতো। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দেশের সব গ্রাহককে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার জন্য বর্তমানে যত সংখ্যক টাওয়ার আছে এর এক তৃতীয়াংশ টাওয়ার হলেই যথেষ্ট।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কার্বন ফাইবার টাওয়ার স্থাপন করেছে একটি টাওয়ার কোম্পানি। সেটি পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্যের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে তারা দাবি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, উন্নত বিশ্বে আবাসিক এলাকা থেকে যথাসম্ভব দূরে মোবাইল ফোনের টাওয়ার স্থাপন করা হয়। এ ধরনের টাওয়ার নবজাতক ও প্রসূতির জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। শিশুর প্রতি অবহেলা কার্যত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নির্দেশক। বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতার বাইরেও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের বৈশ্বিক পুষ্টি প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২২ শতাংশ নবজাতক কম ওজন নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি পাঁচ শিশুর দু’টি খর্বাকৃতি। মোবাইল ফোন টাওয়ারের রেডিয়েশনের কারণেই এমনটি হচ্ছে কি-না তা গবেষণার কথা বলেছেন বিশ্লেষকরা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ইত্তেফাককে বলেন, ‘রাজধানীর বিভিন্ন ভবনের ছাদে মোবাইল ফোন কোম্পানির যে টাওয়ার বসানো আছে, তার জন্য আমাদের কাছ থেকে তারা কোনো অনুমতি নেয়নি। বিষয়টি নিয়ে আমরা নতুন করে ভাবছি।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ইত্তেফাককে বলেন, ‘ভবনের ছাদে বসানো টাওয়ারে কর দেওয়ার একটা নীতিমালা আছে। অথচ মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার বসাতে আমাদের কাছ থেকে কেউ অনুমতি নেয়নি। বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি; কিছু একটা করা যায় কি-না।’
শুধু বারডেম হাসপাতাল নয়, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু ওয়ার্ডের ছাদেও বসানো হয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি মোবাইল টাওয়ার। অথচ এ সব টাওয়ার থেকে উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন হয়। যা নবজাতক ও শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। টাওয়ার পর্যবেক্ষণ ও সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে ছাদে যেসব ভারী যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে, তাতে যে কোনো সময় ছাদের ওই অংশ ভেঙে পড়তে পারে। রাজধানীর আজিমপুরে একটি নামকরা স্কুলের ছাদে বসানো ৫টি টাওয়ার খুলে ফেলার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট অপারেটরকে বারবার অনুরোধ করছে। কিন্তু এ দিকে তারা ভ্রুক্ষেপই করছে না। সবাই মাসিক চার্জ বাড়িয়ে দিতে চায়, কিন্তু খুলে ফেলতে কেউ রাজি নন। ওই স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তারা খুলে না নিলে আমরাই টাওয়ারগুলো খুলে ফেলব।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইলের রেডিয়েশনের ফলে দেশের অগণিত শিশু নানা মানসিক প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত হচ্ছে। সমস্যার আর একটি দিক হলো, আমরা যখন ফোনে কথা বলি না, তখনও ওই বিকিরণ আমাদের ক্ষতি করে চলে। মোবাইল অন থাকলেই তাতে তড়িত্চুম্বকীয় তরঙ্গ আসতে থাকে টাওয়ার থেকে। কানে ফোন নিয়ে কথা বলার সময় সেটি মস্তিষ্কের একেবারে কাছে চলে আসে। বিকিরণ প্রবাহিত হতে থাকে শরীরের মধ্যদিয়ে।
আন্তর্জাতিক ক্যান্সার রিসার্চ সংস্থার মতে, অতিমাত্রায় রেডিয়েশনের কারণে ব্রেইন ক্যান্সার হতে পারে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এর মতে, অতিমাত্রায় মোবাইল ব্যবহারে শরীরের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘক্ষণ কথা বলার কারণে কানের সমস্যা, কানে ঝিমঝিম করা, কানের ভিতরে ব্যথা, ব্রেইনের নিউরনের ক্ষতি, ব্রেনের কোষ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। মোবাইল টাওয়ার রেডিয়েশনের কারণে মানুষের টিউমার, আলঝেইমার, ব্রেইন টিউমার, ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব, নিদ্রাহীনতা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও গর্ভপাতসহ বিভিন্ন রোগ অতিত্রায় বেড়ে গেছে।
সম্প্রতি ভারতে মোবাইল টাওয়ারের ক্ষতিকর দিক বর্ণনা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে বিচ্ছুরিত তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণের জন্য চড়ুই, মৌমাছি, ব্যাঙ, বাদুড় চামচিকা, শালিক, টুনটুনি, ময়না, টিয়া প্রভৃতি অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে বিজ্ঞানিরা দাবি করেছেন। বিকিরণের জন্য বদলে যাচ্ছে পশু-পাখি-পতঙ্গকুলের আচরণ। সাথে সাথে তাদের প্রজননেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
গেল বছর পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গবেষকরা মোবাইল ফোন সৃষ্ট রেডিয়েশনের ভয়াবহতা তুলে ধরেন। সেখানে বলা হয়— তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ লিউকোমিয়া, ব্রেইন ক্যান্সার, স্মৃতিশক্তি হ্রাস ও অন্যান্য মারাত্মক রোগের জন্য বহুলাংশে দায়ী। যারা পেশার তাগিদে শক্তিশালী তড়িত্ চৌম্বকীয় বিকিরণের মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন তারা বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
কোন মন্তব্য নেই
মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷